জুন, জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর– এই চার মাসে বাংলাদেশে ১২ কোটির টাকা ভ্যাট দিয়েছে ফেসবুক। ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাটের হিসাব করলে এই চার মাসে এ দেশে তাদের ব্যবসার পরিমাণ দাঁড়ায় ৭০ কোটি টাকা।
এ হারে বছরজুড়ে এ দেশে ফেসবুকের ব্যবসা দাঁড়ায় ২১০ কোটি টাকার। তবে এটি রাজস্ব বোর্ডে ফেসবুকের দেয়া প্রত্যক্ষ হিসাব, যা এ দেশে তাদের পূর্ণাঙ্গ ব্যবসার একটি অংশমাত্র। ব্যক্তি পর্যায়ে যাদের ভ্যাট নিবন্ধন নেই এবং যাদের উৎসে ভ্যাট কর্তন হয় না, তাদের সঙ্গে ফেসবুকের সেবা কেনাবেচার হিসাব এটি। এর বাইরে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ফেসবুকের সেবার বিনিময়ে যে অর্থ পরিশোধ করে, তারা সরাসরি উৎসে ভ্যাট কর্তন করে নিজেরা রাজস্ব বোর্ডে জমা দেয়। তাদের হিসাব এতে নেই।
ফেসবুক ছাড়া আরও তিন টেক জায়ান্ট গুগল, মাইক্রোসফট ও আমাজন গত ৫ মাসে ১৩ কোটি ভ্যাট জমা দিয়েছে। সব মিলিয়ে চার টেক জায়ান্টের জমা দেয়া ভ্যাটের পরিমাণ গত ৫ মাসে ২৫ কোটি টাকা।
মহামারি করোনার প্রকোপ কেটে গেলে এই চার বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের রাজস্ব আসবে বলে আশার কথা শুনিয়েছেন কর কর্মকর্তা ও অর্থনীতির গবেষকরা। এটি সরকারের রাজস্ব আদায়ের ইতিবাচক ধারাকে আরও বেগবান করবে বলে তারা মনে করছেন।
ফেসবুক, গুগল, মাইক্রোসফট ও আমাজন দেশে নিবন্ধিত চারটি অনাবাসী প্রতিষ্ঠান। তাদের এ দেশে অফিস নেই, কিন্তু তারা নানা ধরনের তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সেবা বিক্রির ব্যবসা করছে। গত পাঁচ মাসে (মে, জুন, জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর) এসব প্রতিষ্ঠান সব মিলিয়ে ১৬০ কোটি টাকার ব্যবসা করেছে।
এগুলো ব্যক্তি পর্যায়ের ছোট ছোট বেচাকেনার চিত্র। ওই চারটি প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট রিটার্ন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
ঢাকা দক্ষিণ ভ্যাট কমিশনারেট থেকে অনাবাসী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ওই চারটি বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান ব্যবসায় নিবন্ধন নম্বর (বিআইএন) নিয়েছে, যা ভ্যাট নিবন্ধন হিসেবে পরিচিত। ওই কমিশনারেটেই প্রতি মাসে ভ্যাট আরোপ হয়। স্থানীয় এজেন্টের মাধ্যমে রিটার্ন দেয় ওই প্রতিষ্ঠানগুলো।
এসব প্রতিষ্ঠানের সেবার ওপর ১৫ শতাংশ হারে কর ধরা হয়েছে।
ফেসবুক, গুগল, মাইক্রোসফট ও আমাজনের সঙ্গে এ দেশে নিবিড়ভাবে কাজ করছেন, এমন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে সেবা বেচাকেনার হিসাবের ওপর ভিত্তি করে এসব প্রতিষ্ঠান ভ্যাট পরিশোধ করেছে।
উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, এক ব্যক্তি ফেসবুকে বুস্টিং বা অন্য কোনো সেবা গ্রহণ করে ১০ ডলার পরিশোধ করল। কিন্তু ওই ব্যক্তি উৎসে ভ্যাট কর্তনকারী প্রতিষ্ঠান কিংবা ভ্যাট নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান নয়। তাই তাদের শনাক্ত করা কঠিন। এমন বেচাকেনার তথ্য এসব অনাবাসী প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট রিটার্নে থাকে। তাই দৃশ্যত ভ্যাটের পরিমাণ কম। বাস্তবে বড় বড় প্রতিষ্ঠান এসব অনাবাসী প্রতিষ্ঠানের কাছে সেবার বিপরীতে মূল্য পরিশোধ করার সময় ভ্যাট কেটে রেখে সরকারি কোষাগারে জমা দেয়।
ঢাকা দক্ষিণ ভ্যাট কমিশনারেটের কমিশনার এস এম হুমায়ূন কবির নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত যা ভ্যাট পেয়েছি, তাতে আমরা খুশি। তবে আরও কয়েক মাস না গেলে মূল্যায়ন করা যাবে না, তারা সঠিক পরিমাণ ভ্যাট দিচ্ছে কি না। এত বড় বড় বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের আইন প্রতিপালন করছে, তা অন্যদের জন্য অনুসরণীয়।’
এই চার প্রতিষ্ঠান থেকে এখন থেকে প্রতিবছর মোটা অঙ্কের ভ্যাট আসবে বলে প্রত্যাশা করছেন হুমায়ূন কবির।
২৩ মে বিশ্বের বৃহত্তম সার্চ ইঞ্জিন গুগল সিঙ্গাপুরে নিবন্ধিত তাদের কোম্পানি এশিয়া প্যাসিফিক পিটিই লিমিটেডের নামে এ দেশে প্রথম অনাবাসী হিসেবে ভ্যাট নিবন্ধন নেয়। এই কোম্পানি বিজ্ঞাপন প্রচারসহ বিভিন্ন সেবা দিয়ে থাকে। মে, জুন, জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর- এই পাঁচ মাসে ভ্যাট রিটার্ন দিয়ে তারা ৮ কোটি টাকার মতো ভ্যাট দেয়। সেই হিসাবে এই প্রতিষ্ঠান ওই পাঁচ মাসে প্রায় ৬০ কোটি টাকার ব্যবসা করেছে।
গত ২৬ মে অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিস ইনকরপোরেশন একইভাবে ঢাকা দক্ষিণ ভ্যাট কমিশনারেটে ভ্যাট নিবন্ধন নেয়। তথ্য সংরক্ষণসহ নানা ধরনের ক্লাউড সেবা দিয়ে থাকে আমাজন ওয়েব সার্ভিস ইনকরপোরেশন। যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি প্রতি মাসেই ভ্যাট রিটার্ন দিয়ে প্রায় ২ কোটি টাকা ভ্যাট দিয়েছে। এ সময়ে ১৫ কোটি টাকার সেবা বিক্রি করেছে আমাজন।
বিশ্বের অন্যতম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের তিনটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান গত ১৩ জুন ভ্যাট নিবন্ধন নেয়। এই তিনটি প্রতিষ্ঠান হলো ফেসবুক আয়ারল্যান্ড লিমিটেড, ফেসবুক পেমেন্ট ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড এবং ফেসবুক টেকনোলজিস আয়ারল্যান্ড লিমিটেড।
সবচেয়ে বড় অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ফেসবুক আয়ারল্যান্ড লিমিটেডের ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা গেছে, এই প্রতিষ্ঠান অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগ ও নেটওয়ার্ক সেবা দিয়ে থাকে। ফেসবুকের ওই তিনটি প্রতিষ্ঠান জুন, জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর- এই চার মাস ভ্যাট রিটার্ন দিয়েছে। সব মিলিয়ে তারা ১২ কোটি টাকা ভ্যাট দিয়েছে। প্রায় ৭০ কোটি টাকার ব্যবসা করেছে ফেসবুক।
জুলাই মাসে ভ্যাট শনাক্তকরণ নম্বর (বিআইএন) নেয় মাইক্রোসফট। আগস্ট সেপ্টেম্বর দুই মাসে এই প্রতিষ্ঠঅনটি প্রায় ৪ কোটি টাকা ভ্যাট দিয়েছে।
অনাবাসী প্রতিষ্ঠানগুলো (যাদের এ দেশে স্থায়ী কার্যালয় নেই) এ দেশে বিজ্ঞাপন প্রচারসহ নিজেদের নানা ধরনের সেবা দিয়ে থাকে। এসব সেবার ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট বসে। এসব সেবা নিয়ে গ্রাহকরা ক্রেডিট কার্ড বা অন্য কোনো উপায়ে ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ পরিশোধ করে থাকেন। দেশের বাইরে থেকেই মূল্য পরিশোধ করা হলেও তা ভ্যাট রিটার্নে দেখাতে হয়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সরকারের রাজস্ব আদায়ের একটা ভালো উৎস খুঁজে পেয়েছে এনবিআর। এই চার প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা দেশে যত বাড়বে; সরকারের রাজস্ব তত বাড়বে।’
এই চার প্রতিষ্ঠান থেকে বছরে কী পরিমাণ ভ্যাট সরকার পেতে পারে- এ প্রশ্নের উত্তরে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘সেটা এখনই সুনির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। করোনার কারণে অনেক কিছুই স্বাভাবিক ছিল না; তারপরও এই পাঁচ মাসে আশাব্যঞ্জক ভ্যাট পাওয়া গেছে। বছরখানেক গেলে বোঝা যাবে, এদের কাছ থেকে কী পরিমাণ রাজস্ব পাবে সরকার। তবে এটা বলতে পারি, দিন যত যাবে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে তত বেশি ভ্যাট আসবে।’
সবচেয়ে বড় সুসংবাদ হচ্ছে, রাজস্ব আদায়ে জোয়ার লক্ষ করা যাচ্ছে। অর্থনীতি যে ঘুরে দাঁড়িয়েছে তা রাজস্ব আদায়ের দিকে তাকালেই বোঝা যায়।
করোনার প্রভাবে সৃষ্ট গভীর খাদ থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে দেশের রাজস্ব খাত। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) রাজস্ব আদায় বেড়েছে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় পাঁচ গুণ।
এনবিআরের সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, মহামারির এই সংকটের সময়েও চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সব মিলিয়ে ৫৮ হাজার ৩৫১ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ১৭ শতাংশ বেশি।
এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলছেন, ‘আমদানি-রপ্তানিতে গতি এসেছে। চাঙা হচ্ছে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি। এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে রাজস্ব আহরণে।’