৪৯ লাখ শেয়ার নিয়ে গুঞ্জন আমান ফিডের!

0
439
HTML tutorial

আমান ফিডের আর্থিক অবস্থা, উৎপাদন ও বিপনন কার্যক্রম ও প্রতিবেদন নানা অনিয়ম অসংগতিতে ভরা। আর্থিক প্রতিবেদনে কারসাজি ও করপোরেট গভর্নেন্স পরিপালনে অসঙ্গতির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে তদন্ত করেছিল পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। আইপিও মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে সংগৃহীত অর্থ যথাযথভাবে ব্যবহার না করার পাশাপাশি কমিশনের কাছে মিথ্যা তথ্য দেওয়ার কারণে আমান ফিডের প্রত্যেক পরিচালককে (স্বতন্ত্র ও মনোনীত পরিচালক বাদে) ২৫ লাখ টাকা করে জরিমানাও গুনতে হয়েছে।

এছাড়া এবি ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় আমান ফিডের সম্পদ নিলামেও উঠেছিল। আমান ফিডের এতসব অনিয়ম অসঙ্গতি বিএসইসির তদন্তের মধ্যে পড়েও হু হু করে শেয়ারদর বাড়ছে কোম্পানিটির। কার্যক্রমের সঙ্গে অনিয়ম জুড়ে যাওয়া এই কোম্পানির শেয়ারদর অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে চলায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন।

জানা গেছে, পুঁজিবাজারে তালিকভুক্ত ৭টি কোম্পানির আর্থিক অনিয়ম, উৎপাদন ও বিপনন ব্যবস্থা সশরীরে যাচাই করার জন্য দুই স্টক এক্সচেঞ্জ অনুমতি চায় বিএসইসি’র কাছে। গত এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে বিএসইসি ৭ কোম্পানির আর্থিক সক্ষমতা, উৎপাদন পরিস্থিতি ও বিপনন অবস্থা সশরীরে যাচাই করার অনুমিত দেয় দুই স্টক এক্সচেঞ্জেকে।

সাত কোম্পানি হলো-আমান ফিড, নূরানি ডাইং অ্যান্ড সোয়েটার, খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজ, মোজাফফর হোসেন স্পিনিং মিলস, ইন্দো-বাংলা ফার্মাসিউটিক্যালস, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড ও কাট্টলি টেক্সটাইল লিমিটেড। এরই অংশ হিসাবে ডিএসই সম্প্রতি কয়েকটি কোম্পানি পরিদর্শন কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে। এরমধ্যে আমান ফিডের পরিদর্শন কার্যক্রম পুরোপুরি সম্পন্ন শেষ হয়েছে এবং প্রতিবেদন তৈরির পর্যায়ে রয়েছে।

জানা যায়, ডিএসই কর্তৃপক্ষ আমান ফিডের আর্থিক অবস্থা, উৎপাদন ও বিপনন কার্যক্রম ও প্রতিবেদনে নানা অসংগতি ও অনিয়ম পেয়েছে। কোম্পানিটির উপর বিস্তারিত প্রতিবেদন শিগগির বিএসইতে জমা দেবে প্রতিষ্ঠানটি।

আরেকটি সূত্রে জানা যায়, গত বছর আমান ফিডের আর্থিক প্রতিবেদনে কারসাজি ও করপোরেট গভর্নেন্স পরিপালনে অসঙ্গতির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল বিএসইসি। ওই কমিটি কোম্পানিটির ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা তথ্যের সত্যতা যাচাই করে নানা অসংগতি খুঁজে পায়।

তদন্ত কমিটির সদস্যরা হলেন: বিএসইসির সার্ভিল্যান্স বিভাগের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ শামসুর রহমান, করপোরেট ফাইন্যান্স বিভাগের উপ-পরিচালক মো. ইকবাল হোসেন ও ক্যাপিটাল ইস্যু বিভাগের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আসিফ ইকবাল। ওই কমিটির প্রতিবেদনও চূড়ান্ত হয়ে রয়েছে।  এদিকে, স্টক এক্সচেঞ্জের প্রতিবেদন পাওয়ার পর কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে কমিশন।

বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত আমান ফিডের সব আর্থিক প্রতিবেদন খতিয়ে দেখে তদন্ত কমিটি। কোম্পানিটি হিসাব কারসাজির মাধ্যমে মুনাফা বাড়িয়ে দেখায় এবং আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষায় ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ড (আইএএস) এবং ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড (আইএফআরএস) অনুসরণ না করার প্রমাণ পায়।

এদিকে, এবি ব্যাংকের ২৫০ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ না করা এবং ঋণ আদায়ে আমান ফিডের সম্পদ নিলামে বিক্রির বিষয়টিও খতিয়ে দেখে তদন্ত কমিটি। তদন্তে আমান ফিড কোম্পানির অনিয়ম আর্থিক গড়মিলের প্রমাণ পায়। এ সময়ে কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদনে সংশ্লিষ্ট অডিটরের অডিট আপত্তি নিয়েও তদন্ত করা হয়।

এর আগে চলতি বছরের ২৮ জানুয়ারি প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে সংগৃহীত অর্থ যথাযথভাবে ব্যবহার না করার পাশাপাশি কমিশনের কাছে মিথ্যা তথ্য দেওয়ার কারণে আমান ফিডের প্রত্যেক পরিচালককে (স্বতন্ত্র ও মনোনীত পরিচালক বাদে) ২৫ লাখ টাকা করে জরিমানা করে বিএসইসি।

প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালে আইপিওর মাধ্যমে ১০ টাকা ফেসভ্যালুর সঙ্গে অতিরিক্ত ২৬ টাকা প্রিমিয়াম নিয়ে মোট ৩৬ টাকা দরে শেয়ার ছেড়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় আমান ফিড। আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে ৭০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে কোম্পানিটি। তবে আর্থিক প্রতিবেদনে অনেক মুনাফা দেখিয়েও কোম্পানিটি এবি ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করেনি। পরে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ অর্থঋণ আদালতের আওতায় আমান ফিডের স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পদ নিলামে বিক্রির উদ্যোগ নেয়। পরে আদালত বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংককে সমাধানের দায়িত্ব দেয়।

কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কয়েক বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার প্রতি আয় কমছে। ২০১৮ সালে আমান ফিডের শেয়ার প্রতি আয় ছিল ৪.৬৩ টাকা। ২০১৯ সালে ইপিএস কমে ৩.৭৫ টাকা এবং ২০২০ সালে ইপিএস আরও কমে দাঁড়িয়েছে ২.৭১ টাকা। চলতি বছরে জানুয়ারি- মার্চ প্রান্তিকে আমান ফিডের শেয়ার প্রতি আয় হয়েছে ০.৪৫ টাকা। কোম্পানিটি ঋণ পরিশোধ করতে না পারা, আয় কমে যাওয়া এবং উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি না পাওয়ার পরও কোম্পানিটির শেয়ারদর কেন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে?

অনুসন্ধানে জানা গেছে, আমান ফিডের ৭৪ লাখ শেয়ার আইসিবির পোর্টফলিওতে ছিলো। সেখান থেকে ফয়েজ আহমেদ নামে এক কারসাজি চক্রের প্রধান কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ গড়ে ৬০ টাকা দরে ৪৯ লাখ শেয়ার কিনে। শেয়ার কেনার জন্য কোম্পানিটির পরিচালকরা একটি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে টাকার জোগান দেন। ফয়েজ আহমেদ যে দিন ৪৯ লাখ শেয়ার ক্রয় করে সেদিন কোম্পানিটির রেকর্ড পরিমাণ শেয়ার লেনদেন হয়। এর পরিমাণ ছিলো ৮১ লাখ ১৭ হাজার ১২৫টি শেয়ার। তার এই শেয়ার ক্রয় বাজারে প্রভাব ফেলেছে।

বাড়তে শুরু করে কোম্পানিটির শেয়ার দর। আর শেয়ার দর বাড়ায় কোম্পানিটির মালিকপক্ষ ক্রমান্বয়ে শেয়ার বিক্রি করে সেখান থেকে ফায়দা নিচ্ছে। কিন্তু কোম্পানিটি সে সময়েও ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি। তবুও কোম্পানিটির শেয়ার দর রমরমা। ঋণখেলাপি কোম্পানিটির শেয়ার নিয়ে কারসাজি হচ্ছে কি না সেই গুঞ্জন চলছে বিনিয়োগকারীদের মাঝে।

এছাড়া কারসাজি চক্রের মুল হোতা ফয়েজ আহম্মদের বিরুদ্ধে এর আগে মুন্নু কারসাজির অভিযোগ রয়েছে। মুন্নু কারসাজির অভিযোগের দায়ে ঐ কোম্পানির চাকরি ছেড়ে দেন।  চলতি বছরের ৪ এপ্রিল আমান ফিডের শেয়ার দর ছিল ২৬.৯ টাকা। মঙ্গলবার (২১ সেপ্টেম্বর) শেয়ারটির দর দাঁড়িয়েছে ৬৯.৯ টাকা। অর্থাৎ গত ৫ মাসে কোম্পানিটির শেয়ার দর বেড়েছে ১৬০ শতাংশ বা ৪৩ টাকা।

এ বিষয় জানতে চাইলে কোম্পানিটির চিফ ফাইন্যান্সিয়াল অফিসার (সিএফও) নির্মল চন্দ্র ঢাকা বলেন, ‘করোনাকালে বেশিরভাগ কোম্পানি আয় করতে পারেনি। সে তুলনায় আমান ফিডের ব্যবসা একেবারে খারাপ না। আর কোম্পানিটি নিয়মিত বিনিয়োগকারীদের ভালো কিছু দিয়ে আসছে। তবে শেয়ার নিয়ে মালিকদের কারসাজির আমার জানা নেই।’

ঋণখেলাপির বিষয়ে নির্মল চন্দ্র বলেন, ‘এবি ব্যাংকের সঙ্গে আমাদের ঋণ পরিশোধের বিষয়ে নতুন করে আবারও সময় নেওয়ার কথা চলছে। ইতোমধ্যে আমরা একটি কিস্তি পরিশোধ করেছি। বাকি অর্থ পরিশোধের জন্য ব্যাংক থেকে সময় নেয়ার চেষ্টা করছি।’ তবে কত সময়ের জন্য ব্যাংক বরাবর আবেদন করা হচ্ছে নির্মল তা বলতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘ব্যাংকের অর্থ পরিশোধের চেষ্টা করায় ব্যাংকের সঙ্গে এখন আমাদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক অগ্রগতি পাচ্ছে। শেয়ার দর বৃদ্ধির কোনো সংবেদনশীল তথ্য আমাদের কাছে নেই। এ বিষয়ে ডিএসই বরাবর জানানো হয়েছে।

তবে আমাদের ব্যবসা যে খারাপ যাচ্ছে তাও কিন্তু নয়।’ ২০২০ সালে শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ১২.৫০ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করে। এর মধ্যে ১০ শতাংশ নগদ এবং ২.৫০ শতাংশ বোনাস। প্রতিষ্ঠানটির মুনাফাও প্রতিবছর কমছে। ২০১৮ সালে আমান ফিডের নিট মুনাফা ছিল ৫৩ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। ২০১৯ সালে তা কমে ৪৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা এবং ২০২০ সালে মুনাফা আরও কমে ৩৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা দাঁড়িয়েছে।

এ বিষয়ে কোম্পানির সচিব মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে একটি কিস্তি পরিশোধ করেছি। বাকি টাকা পরিশোধের জন্য ব্যাংকের কাছে সময় চেয়েছি। প্রথম কিস্তি পরিশোধের ফলে ব্যাংকের সঙ্গে আমাদের ব্যবসায়িক সুসম্পর্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে নতুন করে যে সময় চেয়েছি তা এখনও পাইনি। কিস্তি পরিশোধের নতুন সময় পেলে আমরা প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যম জানিয়ে দেব।’

এর আগে আমান ফিড লিমিটেডকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দিয়েছিল আদালত। এই সময়ের মধ্যে প্রতি মাসে কিস্তি হিসেবে কমপক্ষে ২০ কোটি টাকা করে পরিশোধ করতে হবে। বকেয়া ঋণের কারণে জমি ও কারখানা নিলামে তোলার বিরুদ্ধে আমান ফিডের করা এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট এই নির্দেশ দিয়েছে। পাশাপাশি নিলাম স্থগিত রাখার কথা বলেছে হাইকোর্ট।

আদালতের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, যদি আমান ফিড প্রথম কিস্তি অক্টোবর মাসের মধ্যে পরিশোধ না করে তবে এবি ব্যাংক ফের আমান ফিডের জমি ও কারখানা নিলামে তুলতে পারবে। কিন্তু কোম্পানিটি ব্যাংকের সাথে সমন্বয় করে জানুয়ারিতে প্রথম কিস্তির ৩০ কোটি টাকা পরিশোধ করে। বাকি টাকা পরিশোধের জন্য আবার নতুন করে সময় চেয়ে ব্যাংক বরাবর আবেদন করেছে।

HTML tutorial

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here