সম্প্রতি পুঁজিবাজারের বেশ কয়েকটি সংবেদনশীল ইস্যুতে দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসই) মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে পুঁজিবাজারে টানা দরপতন দেখা দেয়। এমন পরিস্থিতির মধ্যে গত মঙ্গলবার বৈঠকে বসে উভয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
বাংলাদেশ ব্যাংক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর বিএসইসি কমিশনার ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, পুঁজিবাজারের উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংক খুবই আন্তরিক। যে কারণে তারা বন্ডে বিনিয়োগকে বিনিয়োগ সীমার বাহিরে রাখার অঙ্গীকার করেছেন। এছাড়া বিনিয়োগ সীমা গণনায় বাজার দরের পরিবর্তে কস্ট প্রাইসকে বিবেচনায় নেওয়ার যে দীর্ঘদিনের চাহিদা রয়েছে, সেটাও সমাধান করার জন্য যা করণীয় তারা তা করবেন। এছাড়া, স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডের বিষয়ে কিছু আইনগত অস্পষ্টতা থাকলে এই বিষয়েও বাংলাদেশ ব্যাংক অনেক আন্তরিক।
বিএসইসির পক্ষ থেকে এমন বক্তব্য আসার পরের দিন বুধবার শেয়ারববাজারে বড় উত্থান হয়। ওইদিন ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ১৪৩ পয়েন্ট বৃদ্ধি পায়। এরপর সন্ধ্যার দিকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, বিএসইসির বরাতে সংবাদ মাধ্যমে পুঁজিবাজারের বিভিন্ন ইস্যুতে যে খবর প্রকাশিত হয়েছে, তা সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে, বৈঠকে পুঁজিবাজারের কোন ইস্যুতেই কোন সিদ্ধান্ত হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন ১৯৯৩-এ শেয়ারবাজারে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগের বিষয়ে বিদ্যমান কতিপয় আইনি সীমাবদ্ধতার বিষয়ে বিএসইসির প্রতিনিধি দলকে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সভার পরে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের প্রতিনিধির বরাত দিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ওই সভার কতিপয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে সংবাদ প্রচার করা হয়েছে, তা সঠিক নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর একেএম সাজেদুর রহমান খানের সভাপতিত্বে বিএসইসির সঙ্গে পূর্ব নির্ধারিত এ সভা কেন্দ্রীয় ব্যাংক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বিএসইসির উদ্যোগে ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড গঠনের ফলে তফসিলি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সৃষ্ট জটিলতা নিরসন এবং পুঞ্জিভূত লোকসান বিদ্যমান থাকলেও সংশ্লিষ্ট বছরের মুনাফা হতে ক্যাশ ডিভিডেন্ড বিতরণের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
এছাড়া সভায় ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ এর ৩৫(১)(গ) ধারা ও ২২ ধারা এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন ১৯৯৩ এর ১০ ধারার বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করে ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অদাবিকৃত তহবিল স্থানান্তর এবং পুঞ্জিভূত লোকসান থাকা সত্ত্বেও ক্যাশ ডিভিডেন্ড দেওয়া আইনসম্মত নয় বলে অভিহিত করা হয়েছে। এ বিষয়ে বিএসইসির নির্দেশনায় প্রয়োজনীয় সংশোধন আনতে অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক- বলেও বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এমন নেতিবাচক বিজ্ঞপ্তি আসার পর শেয়ারবাজর সংশ্লিষ্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন গ্রুপে বিনিয়োগকারীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়। ফলে পরের দিন বৃহস্পতিবার লেনদেনের শুরুতে শেয়ারবাজারে বড় ধরনের দরপতন দেখা দেয়।
এদিন লেনদেন শুরু হওয়ার আগেই প্রি-ওপেনিংয়ে শেয়ারের দাম কমিয়ে বিক্রির প্রস্তাব দেন বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ। ফলে লেনদেনের শুরুতে অংশ নেওয়া প্রায় সবকটি প্রতিষ্ঠানের বড় পতন হয়। এতে লেনদেন শুরুর প্রারম্ভেই ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ৮৬ পয়েন্ট কমে যায়। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে দেখা দেয় আতঙ্ক।
তবে লেনদেন শুরুর কিছুক্ষণ পরেই সংবাদ আসে শেয়ারবাজার নিয়ে ৭ ডিসেম্বর বৈঠক ডেকেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও বিএসইসির প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন। এতে শুরুর পতনের ধাক্কা কাটিয়ে ঊর্ধ্বমুখী ধারায় ফিরে শেয়ারবাজার।
এদিন লেনদেনের শেষদিকে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বাড়ায় সূচকের বড় উত্থান হয়। ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ৮৯ পয়েন্ট বেড়ে ছয় হাজার ৯৩৬ পয়েন্টে উঠে আসে। অপর দুই সূচকের মধ্যে বাছাই করা ভালো কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই-৩০ সূচক ৪৬ পয়েন্ট বেড়ে দুই হাজার ৬৩৫ পয়েন্টে অবস্থান করেছে। আর ডিএসই শরিয়াহ্ সূচক ২১ পয়েন্ট বেড়ে এক হাজার ৪৫৮ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।
দিনভর ডিএসইতে লেনদেনে অংশ নেওয়া ২০৮ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট দাম বাড়ার তালিকায় নাম লিখিয়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ১১৮টির। আর ৪৮টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। বাজারটিতে লেনদেন হয়েছে এক হাজার ২৪৫ কোটি ১৯ লাখ টাকা। আগের দিন লেনদেন হয় এক হাজার ১০২ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এ হিসেবে লেনদেন বেড়েছে ১৪২ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।
অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক মূল্যসূচক সিএএসপিআই বেড়েছে ২৫৬ পয়েন্ট। বাজারটিতে লেনদেন হয়েছে ৬২ কোটি ১৯ লাখ টাকা। লেনদেনে অংশ নেওয়া ২৬৫টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৫৯টির দাম বেড়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ৮৫টির এবং ২১টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজার এমন ঘুরে দাঁড়ানোর কারণ হিসেবে বিএসইসির প্রতি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থার পরিচয় ফুটে উঠেছে। যদিও এর পেছনে রয়েছে বিএসইসির সাথে অর্থমন্ত্রনালয়ে বৈঠকের খবর। তবে বিএসইসির সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের যে ভালো বোঝাপড়া রয়েছে, এ বিষয়টি বিনিয়োগকারীদের সামনে পরিস্কার হয়েছে।
এদিকে, বৃহস্পতিবার বিকালে ডিএসইর এক অনুষ্ঠানে বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবায়াত-উল-ইসলাম বলেছেন, আগামী কিছুদিনের মধ্যেই দেশের শেয়ারবাজারের প্রতি সরকারের যে সুনজর রয়েছে, তা দৃশ্যমান হবে।
তিনি বলেন, ‘আপনারা গত তিন-চার বছর অনেক কষ্ট করেছেন। আশা করছি এক বছরে আপনাদের ব্যবসায়ীক যেরকম উন্নতি হয়েছে, আগামী দিনগুলোতে আরও ব্যাবসায়িক উন্নতি হবে।’
এর আগের দিন বুধবার বিএসইসি চেয়ারম্যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিক বিষয়াবলী প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন।
বৈঠকশেষে সংবাদ মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয় যদিও তিনি বিস্তারিত জানাননি, তবে বৈঠককে ‘সুপার’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, বৈঠকের প্রাপ্তি আশার চেয়ে অনেক বেশি।
বৃহস্পতিবারের বক্তব্যে তিনি প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের উচ্ছাসই পুন:ব্যক্ত করেছেন। শেয়ারবাজারের প্রতি সরকারের আগ্রহ ও সুনজরের কথা বিএসইসির চেয়ারম্যান দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেছেন।
গত কয়েকদিনের ঘটনা পর্যালোচনায় স্পষ্ঠভাবে বুঝা যায়, শেয়ারবাজার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক মোটেও ইতিবাচক নয়। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শেয়ারবাজার এবং শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের বিষয়ে সব সময়ে সহানুভূতিশীল। তিনি শেয়ারবাজারের ক্রান্তিলগ্নে অতীতেও ‘ত্রাণকর্তা’ হিসেবে আর্বিভূত হয়েছেন।
অন্যদিকে, অর্থ মন্ত্রণালয়ও শেয়ারবাজার বিষয়ে বর্তমানে চেয়ারম্যানের আমলে ইতিবাচক ভূমিকায় রয়েছে। তিনি বরাবরই অর্থ মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা পেয়েছেন।
সব মিলিয়ে আগামী ৭ ডিসেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিতব্য বৈঠকের ফলাফল শেয়ারবাজারের জন্য আর্শীবাদই বয়ে আনবে-এমনটাই আশাবাদী শেয়ারবাজারের ৩০ লাখ বিনিয়োগকারীর।